উদ্বোধন ৫ প্রকল্পের, দুটির ভিত্তি স্থাপন * বাণিজ্য, কানেকটিভিটি ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার * সীমান্ত হত্যা ও তিস্তা নিয়ে আলোচনা * বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে মোদির শ্রদ্ধা নরেন্দ্র মোদি আগামীর অভিযাত্রায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত। একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় পাশে দাঁড়াবে প্রতিবেশী দেশটি। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং দুদেশের সহযোগিতার এ পথচলা অব্যাহত রাখবে ভারত।
শনিবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দুদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিষয়ে সহযোগিতা ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন দুই সরকারপ্রধান।
এছাড়া বৈঠকে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, তিস্তাসহ দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, খেলাধুলাসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পাঁচটি প্রকল্প উদ্বোধন এবং দুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। দুদিনের সফর শেষে শনিবার রাতেই ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন নরেন্দ্র মোদি।
এর আগে নরেন্দ্র মোদি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পুজো দিয়েছেন। সেখান থেকে টুঙ্গিপাড়ায় এসে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলা ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি গিয়ে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা দেন মোদি। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দুই নেতার বৈঠক শেষে দুদেশের মধ্যে ৬২ দফা যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকরে বলেন, দ্রুত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় তারা জানায়নি। মন্ত্রী বলেন, শুধু তিস্তা নয়, ছয়টি যৌথ নদীর নায্য হিস্যার বিষয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন।
জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আব্দুল মোমেন বলেন, সীমান্তে হত্যার বিষয়টিও শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে বলেছেন। তিনি এ সমস্যার সমাধানে তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। এর জবাবে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সীমান্তে হাট তৈরি করা গেলে এ সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ওই দেশের ভূমিকা সম্পর্কে আব্দুল মোমেন বলেন, ভারত মনে করছে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। সেটিই নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দুদেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত বিষয় আছে, এর সবই এ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দেশ দুটির হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের উন্নয়নে দুদেশ একসঙ্গে কাজ করতেও আঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, এ সফর আমাদের জন্য গর্বের ও গৌরবের। শুধু ভারত নয়, বিগত ১০ দিনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সঙ্গে ষাটেরও অধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তারা আমাদের অভাবনীয় সাফল্যে অভিভূত বলেও জানিয়েছেন।
তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গত ১০ দিনের আয়োজন বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। ড. মোমেন বলেন, সব মিলিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সফরে আসার জন্য নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
এর আগে বিকাল ৫টার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। দুই সরকারপ্রধান প্রথমে কিছু সময় একান্তে বৈঠক করেন। পরে তাদের নেতৃত্বে শুরু হয় দুদেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, যা চলে সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
এদিকে দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর খুবই অর্থবহ হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে সোনালি অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছি; এ সফর তার সত্যিকার প্রতিফলন। তিনি বলেন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ভারত ঋণ দেবে। এছাড়াও মহাকাশ প্রযুক্তিতেও সহযোগিতা করবে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে বিবিআইএন নামের সক্রিয় সহযোগিতা রয়েছে। আমরা এ সহযোগিতার অধীনে মোটরযান চুক্তি করেছি। কারণ বাণিজ্য সহযোগিতার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিস্তার পানিচুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে শ্রিংলা বলেন, তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনা তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি এ বিষয়ে ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করার কথা বলেছেন মোদি। আমাদের দুদেশের মধ্যে অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে বহুমুখী সহযোগিতা হতে পারে। যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী তীর সংরক্ষণ এসব। নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
মোদির ওড়াকান্দি সফরের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের কোনো যোগসূত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। রাজধানীর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা ২০১৫ সালে তিনি ব্যক্ত করেন । ওড়াকান্দি ও সাতক্ষীরা সফর তার অংশ। রোহিঙ্গা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাদের ফেরত পাঠাতে ভারত ইতিবাচক ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করবে ভারত। তিনি বলেন, সমৃদ্ধ শক্তিশালী বাংলাদেশ কামনা করে ভারত।
সমঝোতা স্মারক : পরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদির এ সফরে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, রেজিলেন্স এবং প্রশমন বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ ও ভারত। এছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। বাণিজ্য নিয়ে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা বিষয়ে দুদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য, কোর্সওয়ার অ্যান্ড রেফারেন্স বুক সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক এবং রাজশাহী কলেজ মাঠ এবং আশপাশের এলাকায় স্পোর্টস সুবিধা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।
উদ্বোধন করা প্রকল্প- গ্রাউন্ড ব্রেকিং সেরিমনি ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফর পাওয়ার ইভাকুয়েশন ফ্যাসিলিটিজ অব রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, ঢাকা ও নতুন জলপাইগুড়ির মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন মিতালী এক্সপ্রেস, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি রবীন্দ্র ভবনের সম্প্রসারিত উন্নয়ন কাজ, আশুগঞ্জে ইন্ডিয়ান যৌথ বাহিনীর শহিদদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন তিনটি সীমান্ত হাটের উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী মুজিবনগরের মেহেরপুর থেকে নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক চালুর বিষয়ে একটি ভিডিও দেখেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে উপহারের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্সের একটি প্রতীকী চাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এছাড়া ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে উপহার হিসাবে ১.২ মিলিয়ন করোনা টিকা দেয়া হয়। প্রতীকী হিসাবে এ টিকার এক বক্স প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বঙ্গভবনে নরেন্দ্র মোদি : এদিন সন্ধ্যা ৭টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বঙ্গভবনে পৌঁছলে আবদুল হামিদ তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। পরে ক্রেডেনশিয়াল হলে বসে বৈঠক করেন তারা। সাক্ষাৎ শেষে পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। পরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করে শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে টিকা প্রদান করায় রাষ্ট্রপতি ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আশা করেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যেসব টিকা আসার কথা তা যথাসময়ে আসবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে প্রেস সচিব বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে ভারত সব সময় বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে ভারত সব সময় পাশে থাকবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, এ সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘যুগান্তকারী মাইলফলক’ হিসাবে থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী শান্তি পুরস্কার দেওয়ায় ভারতের সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্ব মানবতা ও নিপীড়িত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা এ পুরস্কার।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য ভারতের সরকার ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানান আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ভারতসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়। ভারত আমাদের কাছের প্রতিবেশী এবং পারস্পরিক মর্যাদা, আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে একে-অপরের বিশ্বস্ত বন্ধু। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সেখানে ছিলেন।
যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে পুজো : সফরের দ্বিতীয় দিন শনিবার সকাল ১০টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে শ্যামনগরে যান নরেন্দ্র মোদি। সেখানে সোবাহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বানানো হেলিপ্যাডে নেমে সড়কপথে তিনি যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে যান। খদ্দরের পাঞ্জাবি ও গলায় উত্তরীয় পরিহিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে ছিল কড়া নিরাপত্তা।
লালপাড়ের সাদা শাড়ি পরে স্থানীয় তরুণীরা শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে মন্দির চত্বরে স্বাগত জানান তাকে। পরে মন্দিরে প্রবেশ করে মোদি কালী প্রতিমায় মুকুট পরান। নানা বস্ত্রে দেবীকে সাজিয়ে জবা ফুলের মালা পরিয়ে শুরু করেন আরাধনা। প্রার্থনা শেষে তিনি মন্দিরের প্রতিমা এবং গর্ভগৃহ প্রদক্ষিণ করেন। প্রায় ২১ মিনিটের এ প্রার্থনা পর্ব পরিচালনা করেন মন্দিরের পুরোহিত দিলীপ মুখার্জি।
যশোরেশ্বরী মন্দিরে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মন্দিরে দুই হাজার রুপি উপহার দেন এবং একটি কমিউনিটি হল কাম সাইক্লোন শেল্টার গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজো দেওয়ার পরপরই তিনি হেলিকপ্টারে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে রওনা হন। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে তিনি টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছান। সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুল দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।
বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর নরেন্দ্র মোদি বঙ্গবন্ধুর সমাধির সামনে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে উপস্থিত সবাই দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন। পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার উপস্থিতিতে দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করে মোদি সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন এবং একটি গাছের চারা রোপণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঙালির সংগ্রামেরই ইতিহাস : দর্শনার্থী বইয়ে নরেন্দ্র মোদি লেখেন, ‘অধিকার, নিজস্ব সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষের যে সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর জীবন তারই প্রতিচিত্র। তার অবিনাশী চেতনা আর অদম্য সাহস কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তারা পরিণত হয়েছে বিজয়ী জাতিতে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘ভারতবাসী বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে একজন বীর হিসাবে, সেই ভারতবাসীর পক্ষে আমি ২০ শতকের এ মহান রাষ্ট্রনেতার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম, যে ইতিহাসকে তিনি নতুন রূপ দিয়েছেন দৃঢ় সংকল্প আর আত্মত্যাগের প্রবল শক্তি দিয়ে।’
মোদি লিখেছেন, ‘এ ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর দিয়ে যাওয়া সাম্য, মুক্তি আর ন্যায়বিচারের চেতনা আমাদের ভবিষ্যতেও পথ দেখিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ পরিবর্তনের নজির, ভারত সহযাত্রী : টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কাশিয়ানীতে মতুয়া সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ওড়াকান্দি মন্দিরে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা দেন এবং পরে মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নেন।
এ সময় বাংলাদেশকে বিশ্বে বিকাশ ও পরিবর্তনের শক্তিশালী উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত এ প্রচেষ্টায় সহযাত্রী। তিনি বলেন, ভারত আজ সবার সাথে, সবার বিকাশ এবং সবার বিশ্বাস- এ মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ এতে সহযাত্রী। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সামনে বিকাশ আর পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী উদাহরণ পেশ করছে। সেই প্রচেষ্টায় ভারত আপনাদের সহযাত্রী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বিশ্বাস আছে, শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আশীর্বাদে গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রেরণায় আমরা দুদেশে একবিংশ শতকের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করব। ভারত এবং বাংলাদেশ উন্নতি ও প্রেমের পথে বিশ্বে পথপ্রদর্শন করতে থাকবে। তিনি বলেন, একভাবে এ স্থান ভারত ও বাংলাদেশের আত্মিক সম্পর্কের তীর্থস্থান। আজ শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের আশীর্বাদের এ পুণ্যভূমিতে প্রণাম করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি মাথানত করে প্রণাম জানাচ্ছি।
এ পবিত্র মুহূর্তের প্রতীক্ষা আমার বহু বছর ধরে ছিল : নরেন্দ্র মোদি বলেন, এ দিনের এ পবিত্র মহূর্তের প্রতীক্ষা আমার বহু বছর ধরে ছিল। ২০১৫ সালে যখন আমি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথমবার বাংলাদেশে আসি, তখনই আমি এখানে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। আমার সেই প্রত্যাশা-কামনা আজ পূর্ণ হলো। আমি নিয়মিতভাবে শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীদের থেকে ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছি, পরিবারের সদস্যদের ঘনিষ্ঠতা পেয়েছি।
মোদি বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশ নিজেদের বিকাশ ও প্রগতির চেয়ে সমগ্র বিশ্বের উন্নতি দেখতে চায়। উভয় দেশই পৃথিবীতে অস্থিরতা, সন্ত্রাস এবং অশান্তির পরিবর্তে স্থিতিশীলতা, প্রেম এবং শান্তি চায়। এ শিক্ষাই শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর আমাদের দিয়েছেন। আজ সমগ্র বিশ্ব যে মূল্যবোধের কথা বলে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, সেই মূল্যবোধের জন্য হরিচাঁদজী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
পশ্চিমবাংলায় ঠাকুরনগর সফরে মতুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মোদি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগর থেকে বাংলাদেশের ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত একই রকমের শ্রদ্ধা রয়েছে। একই রকমের আস্থা রয়েছে। একই রকমের অনুভূতি রয়েছে। তিনি বলেন, আজ সব ভারতবাসীর সৌভাগ্য যে তারা এখানে বাংলাদেশে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।
ওড়াকান্দিতে শিক্ষার অভিযানে এখন থেকে ভারতের জনগণও যুক্ত হবে, ওড়াকান্দিতে মেয়েদের মিডল স্কুল আপগ্রেড করবে, নতুন নতুন সুবিধা প্রদান করবে। ভারত সরকার এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করবে। এটি ভারতের কোটি কোটি জনগণের পক্ষ থেকে শ্রীশ্রী হরিচাদ ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা এ কাজে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।
তীর্থযাত্রা আরও সহজে পদক্ষেপ নেব : ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মতুয়া সম্প্রদায়ের আমার ভাইবোন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীর পুণ্যলগ্নে প্রতি বছর বারুণী স্নান উৎসব পালন করেন। ভারত থেকে প্রচুর সংখ্যক পুণ্যার্থী এ উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য ওড়াকান্দি আসেন।
আমার ভাইবোনদের জন্য এ তীর্থযাত্রা যাতে আরও সহজ হয় সেজন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে মোদি বলেন, আমি বাংলাদেশের জাতীয় অনুষ্ঠানে ভারতের ১৩০ কোটি ভাইবোনের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি।
আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। ঢাকায় জাতীয় দিবস পালনের সময় আমি বাংলাদেশের শৌর্য ও ক্ষমতার এবং সংস্কৃতির অপূর্ব প্রদর্শন দেখেছি। যা এ০ অপূর্ব দেশ দেখিয়েছে, তার অংশীদার আপনারাও।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর কথা তুলে ধরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব, তার দূরদৃষ্টি আর বাংলাদেশের মানুষের ওপর উনার বিশ্বাস এক উদাহরণ। ওড়াকান্দিতে মোদি আরও বলেন, আজ ভারত এবং বাংলাদেশের সামনে একইরকম চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা সমাধানের জন্য শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুপ্রেরণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দুই দেশের একজোট হয়ে প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা উচিত। এটি আমাদের কর্তব্য, দুদেশের কোটি কোটি জনগণের কল্যাণের পথ। করোনাভাইরাস মহামারি প্রসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারির সময়ে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই নিজেদের সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়েছে। আজ উভয় দেশ মহামারির জোরদার মোকাবিলা করছে, একসঙ্গে মিলে মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশের নাগরিকের কাছে যাতে ভ্যাকসিন পৌঁছায় ভারত এটিকে নিজেদের কর্তব্য ভেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে যোগ দিতে দুদিনের সফরে শুক্রবার ঢাকায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। শুক্রবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকালে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন সম্মানিত অতিথি হিসাবে। দুদিনের সফর শেষে শনিবার রাতেই ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন নরেন্দ্র মোদি।
caller_get_posts
is deprecated. Use ignore_sticky_posts
instead. in /home/somoynewsbd/public_html/wp-includes/functions.php on line 5667caller_get_posts
is deprecated. Use ignore_sticky_posts
instead. in /home/somoynewsbd/public_html/wp-includes/functions.php on line 5667
Leave a Reply