– মাহবুব করিম
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী শারীরিক ভাবে খুব একটা ভালো ছিলেন না – সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস এর উপর নির্ভর করে বেঁচে ছিলেন!!
কিন্তু ডায়ালাইসিস ওনাকে থামাতে পারে নি – এর মধ্যেই ছুটে চলেন – শহর থেকে শহরে – গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দেশ থেকে দেশে। এইতো সেদিন অল্প কয়দিনের জন্য ঘুরে এলেন আমেরিকা।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অফুরন্ত শক্তি, উৎসাহ, প্যাশন কাজ করে এই ছুটে চলার পিছনে। (সত্তর দশকে) সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল দেশের মধ্যবিত্তের আল্টিমেট প্রকাশনা – বিচিত্রার এনডোর্সমেন্ট ছিল সর্বোচ্চ প্রচারণা। সত্তর দশকের বিচিত্রায় বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খাম ভাসানী প্রমুখ ছাড়া হাতে গোনা আর যে কজন বিচিত্রার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন – ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁদের একজন।
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক – স্বাধীনতা পদক পান আজ থেকে ৪৬ বছর আগে – ১৯৭৭ সালে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষে প্রথম যে বৈঠকটি হয়, তা অনুষ্ঠিত হয় ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে। পরে অনেক বছর উনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান ছিলেন।
চট্টগ্রামে জন্ম হলেও ডাঃজাফরুল্লাহ চৌধুরী বড় হয়েছেন পড়াশোনা করেছেন ঢাকাতে। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশন, ঢাকা কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ১৯৬৪ সালে তিনি বিলেত চলে যান উচ্চশিক্ষার জন্য এবং জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস নেন। এর মধ্যে চলে আসে ১৯৭১ সাল। ফিরে আসেন দেশে, সাধারণ সৈনিক হিসেবে অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যোগ দেন। পরে একটা ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজন দেখা দিলে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল – ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’! ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও আরেকজন বিলেত ফেরত একসিডেন্ট ইমারজেন্সি চিকিৎসক – ডাঃ মবিন মিলে।
একাত্তরের পর দেশে ফিরে উনি ইচ্ছে করলে ঢাকার প্রধানতম সার্জারি প্র্যাক্টিশনার হয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তিনি ফিরে যান গ্রামে- আরেক যুদ্ধ ক্ষেত্রে। সাভারে গড়ে তোলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। ওনার পাইলট প্রজেক্ট গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রাইমারী কেয়ার কনসেপ্ট মাঠে প্রমাণ করেন এবং এর ভিত্তিতে WHO আর UNO আলমা আটা কনফারেন্সের মাধ্যমে গ্লোবাল ইউনিভার্সাল প্রাইমারী কেয়ার প্রকল্পের ঘোষণা দেয়।
গ্লোবাল প্যারামেডিক যে কনসেপ্ট – তার প্রথম উদ্ভাবক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এর ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ট্রেইন্ড প্যারামেডিক দিয়ে মিনি ল্যাপারোটমির মাধ্যমে লাইগেশন সার্জারির উদ্ভাবক ডাঃজাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সংক্রান্ত তাঁর পেপারটি বিশ্ব বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট এ মূল আর্টিকেল হিসেবে ছাপা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মূল পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের একটা চ্যাপ্টার ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখতেন অনেক বছর ধরে। দেশে বিদেশে ডাঃজাফরুল্লাহ চৌধুরীর লেখা বই আর পেপার প্রচুর। প্রাইমারি কেয়ার নিয়ে লিখা ওঁনার সম্পাদিত ও প্রকাশিত একটি বই “যেখানে ডাক্তার নেই” একসময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পাওয়া যেত।
১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী শিক্ষা কমিটির মেন্বার হিসেবে আমাদের শিক্ষা নীতি আর নারী নীতি তে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
তবে গণস্বাস্থের পর তার ম্যাগনাম ওপাস হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। সমগ্র বিশ্ব আজ অবাক হয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশের মতো দেশ কিভাবে এ ধরণের একটা র্যাডিকেল নীতি বাস্তবায়ন করলো! স্বাধীনতার পর এই ঔষুধ নীতি স্বাস্থ খাতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।
এই তো সেদিন ও ওনাকে দেখলাম মিছিলের সামনে। কিছুদিন আগে এক নাগরিক সভায় বক্তা হিসেবে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী মাঝখানে কোভিডের সময় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিদেশে যাবার কথা হচ্ছিলো অথচ তিনি যাননি। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন।
“কোভিডের সব পেশেন্ট আমার হাসপাতালে আসছে আর এখানে মারা যাচ্ছে – কোন বিবেচনায় আমি নিজে অন্য হাসপাতালে যাবো?
ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু হলো নিজের হাসপাতালেই – গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)
আপনাকে রাষ্ট্র কিভাবে মূল্যায়ন করবে আমি জানি না।
তবে আমার চোখে আপনি একজন সত্যিকারে দেশপ্রেমিক।
আপনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
caller_get_posts
is deprecated. Use ignore_sticky_posts
instead. in /home/somoynewsbd/public_html/wp-includes/functions.php on line 5667caller_get_posts
is deprecated. Use ignore_sticky_posts
instead. in /home/somoynewsbd/public_html/wp-includes/functions.php on line 5667
Leave a Reply