নিজস্ব প্রতিবেদকঃবাংলাদেশের সমন্বিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক, প্যারিস চুক্তি ও জি৭ এর নানান অঙ্গীকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি আমাদের নেট জিরো লক্ষ্যকেও খর্ব করে। জাপানের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় এ বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনাটি তৈরি করেছিল ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস, জাপান (আইইইজে), তাদের সহযোগিতা করেছিল জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এই মহাপরিকল্পনা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে আরও আর্থিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি-২০৫০ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে তা-ই খতিয়ে দেখা হয়েছে।
“এই মহাপরিকল্পনাটি বানানোই হয়েছে জাপানি কোম্পানিগুলোর সর্বোচ্চ লাভ নিশ্চিত করতে, এবং নিজেদের উদ্বৃত্ত এলএনজি এশীয় দেশগুলোর কাছে পুনরায় বিক্রির লক্ষ্যেই কেবল জাপান বাংলাদেশে এ ধরনের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে,” মন্তব্য করেছেন জাপান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটির (জেএসিএসইএস) প্রকল্প পরিচালক ইউকি তানাবে। বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি-২০৫০ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশে ন্যায্য রূপান্তরে দ্বিপাক্ষিত অংশীদারিত্বের ভূমিকা শীর্ষক এক অধিবেশনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিবেচনায় এই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটি (IEPMP) মোটেও কার্যকর হবে না, কেননা এতে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৫% অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেন কো-ফায়ারিং ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, এটি নবায়নযোগ্য শক্তির চেয়ে ৪ গুণ বেশি ব্যয়বহুল।
ইউকি আরও বলেন, “এই আইইপিএমপি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর নয়। এতে উন্নত প্রযুক্তির নামে মিথ্যা ও ব্যয়বহুল সমাধানের কথা উল্লেখ রয়েছে এবং এই অপরীক্ষিত প্রযুক্তিগুলো নবায়নযোগ্য শক্তির তুলনায় খুবই ব্যয়বহুল। তাই, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটির ব্যাপক সংশোধন প্রয়োজন এবং জাপানের উচিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জ্বালানি রূপান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা।”
অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত বাংলাদেশে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহাইড বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া প্রযুক্তিগুলো প্রয়োগ করা উচিত নয়। তবে যখন নতুন এই প্রযুক্তিগুলো কার্যকর বলে প্রমাণিত হবে এবং সার্বিকভাবে প্রযুক্তিগুলোর আরও দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে, তখন প্রয়োজন মতো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা সংশোধন করা যাবে।”
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনাটি যে সংশোধন করা উচিত তা নিয়ে সম্মত হন ইচিগুচি-ও; বাংলাদেশ এনার্জি সমৃদ্ধি সম্মেলন ২০৫০-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় জ্বালানি উপদেষ্টাও এই সংশোধনীর কথা উল্লেখ করেছেন। ইচিগুচি বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা একটি জীবন্ত দলিল। তাই পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে এই মাস্টার প্ল্যানও সংশোধন হওয়া উচিত। জাইকা বাংলাদেশেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ এবং একই সাথে জ্বালানি দক্ষতার লক্ষ্য অর্জনেও সহায়তা করেছে এবং করবে।”
বাংলাদেশে ন্যায্য রূপান্তরে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারীত্বের ভূমিকা শীর্ষক এ অধিবেশনে দেশে জ্বালানি রূপান্তর ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক অংশীদার চীন ও নেপালের বিনিয়োগের গুরুত্বের ওপরও আলোকপাত করা হয়।
এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ এশিয়া প্যাসিফিকের সমন্বয়ক বারিশ হাসান চৌধুরী, অয়েল চেইঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের (ওসিআই) জাপান ফাইন্যান্স ক্যাম্পেইনার মাকিকো আরিমা অধিবেশনটি পরিচালনা করেন।
মূল্য চেইন, নীতি চেইন ও নির্গমন চেইন বিবেচনায় বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন যে অগ্রহণযোগ্য এবং মোটেও টেকসই নয় অধিবেশনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে তা ফুটে উঠেছে। এতে দেখানা হয়েছে যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা খুবই বাজে এবং এটি অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক; অথচ নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে সফলভাবে ৯৭.৮% বিদ্যুৎ পাওয়া যায় এবং এটি বেশ সস্তাও।
নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য জমির সীমাবদ্ধতা, জ্বালানি রূপান্তরে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতা সংক্রান্ত অন্য আলোচনাগুলোতেও বক্তারা বাংলাদেশে জ্বালানি রূপান্তর এগিয়ে নিতে জাপান ও জি৭ দেশগুলোর ভূমিকা, দক্ষিণ এশীয় জ্বালানি সহযোগিতার সম্ভাবনা এবং এডিবি এবং এআইআইবি-র ঐতিহাসিক ভূমিকা ও সামনে কী কী করতে পারে তা নিয়ে কথা বলেন।
ন্যায্য ও টেকসই অর্থায়ন বিষয়ক আরেক অধিবেশনে বক্তারা আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা, কমপ্লায়েন্স ও সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশের শ্রেণিবিন্যাসের কাঠামো সংশোধন এবং বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতেও বলেন, যেখানে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক নীতি, প্রকল্পের নথিপত্র ও ইএসজি প্রতিবেদন প্রকাশ নিশ্চিত করবে।
নীতিনির্ধারক, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন অংশীদার, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারী ও অর্থদাতা, নাগরিক সমাজের নানান সংগঠন ও তরুণ-যুবাসহ ৩০০-র বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি এবারের তিনদিনব্যাপী এই দ্বিতীয় ‘বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি-২০৫০’ সম্মেলনে একত্রিত হয়েছেন। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনের সফলতার ওপর দাঁড়িয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির পথে অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করা এবং টেকসই উন্নয়নে সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বর্ধিত কলেবরে ২৩টি সংগঠনের মিলিত উদ্যোগে এবারের এ আয়োজন হচ্ছে।