মঞ্জুর:
জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে আগে স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। যদি স্থানীয় নির্বাচন ঠিকভাবে না হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে না। তাই জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে আগে সুষ্ঠু স্থানীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা দরকার।
৮ই মার্চ ২০২৫ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিপিএএ) আয়োজিত বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেছেন।
সংলাপে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেছেন—সিপিএএর মডারেটর ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব অধ্যাপক ড. মো. শরিফুল আলম। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাফিউল ইসলাম।
সংলাপে অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. আবদুল কাইয়ূম বলেন, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য আগে স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে না। কাইয়ূম আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রশাসনিক যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, অতীতে কিন্তু এমন সমস্যা দেখা দেয়নি।পুলিশকে এখন আর কার্যকরী প্রতিষ্ঠান আর বলা যায় না। সাধারণ প্রশাসন যারা নির্বাচনের মূল ভূমিকা পালন করবে, তারা যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে-এটা আশা করা যায় না।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এই সরকারেরও সময় শেষ হয়ে আসছে। ডিসেম্বরে তারা না কি নির্বাচন দিবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি, কোনো সংস্কার আসেনি। কিন্তু, তারাই তো ইলেকশন করবে। নতুন পার্টি যেটা গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যেও কোনো পরিবর্তন দেখিনি। আমরা শুনছি, নতুন পার্টিও চাঁদাবাজি করছে। রোজগারের ব্যবস্থা যে সিস্টেমের ছিল, সেভাবেই চলছে। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। আগে হলে অনেক উপকার হবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, বর্তমান সরকারের কাছে একটা দ্বৈততা এসে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রদের যে দল রয়েছে, সেটি মানুষকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে নিক্ষিপ্ত করেছে। সাবেক এ উপাচার্য আরও বলেন, বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে-মানুষ স্থানীয় নির্বাচন আগে চায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর এ নিয়ে মত পার্থক্য আছে। আমাদেরকে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্থানীয় নির্বাচন আগে হতে হয়। তবে, সংস্কার করে সবকিছু করতে হবে।
অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) ড. খন্দকার রাশেদুল হক বলেন, যাদের মাধ্যমে সমাজ এগিয়ে যাবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে, সে ধরনের একটা প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন। যে জিনিসটি এই জাতির জন্য উপকারী এবং জাতিকে একটা সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে, সে সমস্ত লোককে নির্বাচিত করা দরকার বলে আমি মনে করছি।
দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ভেবেছিলাম অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা হয়নি। ভদ্র লোকের রাষ্ট্র আমরা চাই না। আগে জাতীয় না স্থানীয় নির্বাচন তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমরা রাষ্ট্রকে কোথায় নিতে চাই। আমরা কি ভদ্র লোকের রাষ্ট্র চাই, নাকি সকলের রাষ্ট্র চাই-এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে কোনো কমিশন হয়নি। অথচ এটা সব থেকে জরুরি ছিল, তা হয়নি। সোহরাব হাসান আরও বলেন, বাংলাদেশে যত অনির্বাচিত সরকার
এসেছে। তারা সকলে আগে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করেছে। এরপর নতুন দল করে একটা নির্বাচন দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই ভয় পাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করছে না। আবার রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে বিশ্বাস করছে না। নতুনদের প্রমাণ করতে হবে যে-তারা পুরোনোদের থেকে ভিন্ন।
বারভিডা’র সভাপতি আব্দুল হক বলেন, আমরা অর্থনৈতিক লুটপাটের বিষয়ে কোনো আলোচনা শুনছি না। কেবল মাত্র একটা নির্বাচন দিয়ে এ সমস্যাগুলোর সমাধান হবে না। নির্বাচন অবশ্যই লাগবে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া স্থিতিশীলতা আসবে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারটা জরুরি।
বিএনএনআরসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম বজলুর রহমান বলেন, আমাদের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি আসলেই স্থানীয় সরকার চাই? স্থানীয় সরকারে অনেক সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত ও আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নাই। আমরা এবার একটা সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আগে এই খাতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, আমরা আগে বলেছি সংস্কার প্রয়োজন। এর পরে বলেছি নির্বাচনের কথা। আমাদের বর্তমানে ছাত্রদের যে রাজনৈতিক দল রয়েছে তারাও এখন আর সংস্কারের কথা বলে না। আমাদের ছাত্রদের দলও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছু সিটের রাজনীতি করছে। তিনি আরও বলেন, পলিটিক্যাল কালচার পরিবর্তন জরুরি। ড. ইউনূসের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে চাই-কোন কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কারের বিরোধী তা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া উচিত।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, নির্বাচনী আলোচনাটা সংস্কার ও বিচারকে পাশ কাটিয়ে পুশ করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে দখল ও লুটপাটের দোষে দূষিত, নতুনেরা কি সেই কয়লা গায়ে মাখেনি? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের মধ্যে থাকতে হবে।
নির্বাচনের আগে এর কাঠামো ঠিক করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ মাঠে নেই, তাই একটি দলের টিকিট পাওয়ার মানেই নির্বাচিত হয়ে যাওয়া। তাই মনোনয়ন নিয়ে মারপিট হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কারের কথা বললেও দলের মধ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নেই। যাদের নিজের দলে গণতন্ত্র নেই, নেতা-কর্মীরা লুটপাটে যুক্ত তারা দেশের কি সংস্কার করবে। রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সংস্কার করতে পারবে না।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, এখনো পেশিশক্তির কালচার বাংলাদেশে আছে। নির্বাচন করার জন্য একটি ভালো প্রশাসন প্রয়োজন। নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করতে হবে। ভোটারদের ভোট দেওয়ার জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনের পরে জাতীয় নির্বাচন করলে ভালো হবে।
তরুণ শিক্ষক ও গবেষক বুরহান উদ্দিন নোমান বলেন, স্থানীয় নির্বাচনের আগে যদি জাতীয় নির্বাচন হয়, তাহলে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সিলেক্ট করে। এতে করে স্থানীয় নির্বাচন জিম্মি হয়ে থাকে। এই কালচার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় নির্বাচন হলে মানুষের অধিকার ফিরে পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম বলেন, ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের যে সকল সন্তানেরা বিজয় নিয়ে এসেছে, শত্রুরা সেটিকে পরাজিত করতে চায়। বেশি লোভ করলে হবে না। সবকিছু আগে ঠিক করে এরপরে নির্বাচন দেওয়া উচিত।