পহেলা বৈশাখ বাংলা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এই দিনটি বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, যা সাধারণত ১৪ বা ১৫ এপ্রিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে পড়ে। পহেলা বৈশাখের ইতিহাস বাংলা সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে (১৫৫৬-১৬০৫) পহেলা বৈশাখের প্রচলন শুরু হয়, যা বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। এটি মূলত কৃষি ও রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে প্রবর্তিত হয়েছিল। মুঘল আমলে ভারতবর্ষে হিজরি ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল, যা চন্দ্রভিত্তিক। এই ক্যালেন্ডার কৃষি কার্যক্রম ও কর আদায়ের জন্য সুবিধাজনক ছিল না, কারণ চন্দ্রবছর সৌরবছরের তুলনায় ছোট এবং কৃষি ঋতুচক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ফলে কৃষক ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিত। সম্রাট আকবর তার রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও সুশৃঙ্খল করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার জ্যোতির্বিদ ও পণ্ডিতদের নির্দেশ দেন একটি নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করতে, যা কৃষি ঋতুচক্রের সঙ্গে মিলবে এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য সুবিধাজনক হবে। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ শিরাজীকে। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে (৯৯২ হিজরি) একটি সৌর পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন, যা “তারিখ-ই-ইলাহি” নামে পরিচিত ছিল। পরে এটি বঙ্গাব্দ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই পঞ্জিকা কৃষকদের খাজনা আদায়ের সময় নির্ধারণে সহায়ক ছিল। চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা পরিশোধের পর পহেলা বৈশাখে জমিদাররা কৃষকদের মিষ্টি বিতরণ ও উৎসবের আয়োজন করতেন। এটিই ছিল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রাথমিক রূপ। আকবরের এই উদ্যোগ ছিল তার প্রশাসনিক সংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এটি শুধু বাংলা অঞ্চলেই নয়, মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশেও কৃষি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এনেছিল। তবে বাংলায় এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, যা আজও পহেলা বৈশাখের উৎসবে প্রতিফলিত হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হক পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি সমর্থন জানায় যা পাকিস্তানি শাসনের সময়ে বাঙালি সংস্কৃতির উপর ক্রমবর্ধমান চাপের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুক্তফ্রন্ট সরকারের ছুটির ঘোষণা সত্ত্বেও, এই উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। ফলে পহেলা বৈশাখের ছুটি এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাতিল হয়। তবে, এই সময়ের উদ্যোগ বাঙালিদের মনে সাংস্কৃতিক চেতনার বীজ বপন করে, যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুক্তফ্রন্টের পরে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে, পাকিস্তানি শাসনের বাঙালি সংস্কৃতি দমনের প্রতিবাদে পহেলা বৈশাখ উদযাপন একটি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে, যা পাকিস্তানি শাসকদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতার উপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ ছিল। এই আয়োজনে রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়, যা বাঙালি পরিচয়ের একটি শক্তিশালী প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮৯ সালে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে এই বর্ষবরণ উৎসব শুরু করে। পরে ১৯৯৫ সালে এর নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এই শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উদযাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে এবং ২০১৬ সালে ইউনেস্কো এটিকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়
এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম জানান, এটি আসলে নাম পরিবর্তন নয়, বরং নামের পুনরুদ্ধার। এবার নতুন করে দেওয়া হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম। বৈশাখ উদযাপনকে রঙিন করে তুলতে ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে জমে উঠেছে বর্ষবরণ প্রস্তুতি। পয়লা বৈশাখের রুপ ফুটিয়ে তুলতে শোভাযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে বর্ণিল মুখোশ, রঙিন মোটিফসহ বিভিন্ন কাঠামো। শিক্ষার্থীরা তৈরি করছেন রাজা-রানির মুখোস, প্যাচাঁ, জাতীয় পশু বাঘ, ইলিশ, পাখি ও ফুলের রঙিন অবয়ব। এর মাধ্যমে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি তুলে ধরা হবে গ্রামবাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। উঠে আসবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
আজ পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, গান, নৃত্য, পড়াশোনা, এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ দিয়ে উদযাপিত হয়। এই দিনে মানুষ একে অপরের সাথে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশির সাথে আনন্দ ভাগ করে নেয়। নারী-পুরুষরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। ব্যবসায়ীরা এই দিনে নতুন হিসাবের খাতা (হালখাতা) খোলেন এবং গ্রাহকদের মিষ্টি বিতরণ করেন,যা ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির প্রতীক। এই দিনটি ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় বসে মেলা। সেখানে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে বিক্রি হয় মাটির তৈরি নানা জিনিস। মৃৎশিল্পীরা জানান, করোনা মহামারি ও রমজান মাসের কারণে গত কয়েক বছর সেভাবে বৈশাখী মেলা না হওয়ায় থমকে গিয়েছিল তাদের কর্মযজ্ঞ।এই মেলা ঘিরে আয়-রোজগারের নতুন স্বপ্ন দেখছেন মৃৎশিল্পীরা। নতুন বছরকে বরণ ও পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনগণ প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের আগেই বৈসাবি উৎসব পালন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পয়লা বৈশাখ এক নিয়মে পালন করলেও পাহাড়ে পালন করা হয় ভিন্নভাবে। চাকমা লোকরীতির বিশ্বাস, পুরোনো বছরের দু:খ, গ্লানি ও পাপাচার থেকে মুক্তির জন্য গঙ্গা দেবতার উদ্দেএশ ফুল ভাসিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানালে নতুন বছর সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা দেবে। তাই ফুলবিজুর দিন ভোর থেকে বাড়ির পাশের নদী ও খালে গিয়ে প্রার্থনারত হয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় জানায় এ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সী নর-নারী। এভাবে আট দিনব্যাপী ব্যাপক উৎসবে এরা পাহাড়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়, বাঙালির জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির প্রতিফলন। এটি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি পুরনোকে বিদায় দেওয়ার একটি প্রতীকী উদযাপন। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরে গানের শুরে আমরা বলতে পারি, বৎসরের আর্বজনা দুর হয়ে যাক, এসো এসো হে বৈশাখ।
স্বাক্ষরিত
মোঃ রফিকুল ইসলাম
তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ঢাকা ।